তিন বছরের মধ্যে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মোটেও উন্নতি হয়নি, বরং তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ, যা সরকারী হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিশিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) সম্প্রতি এক গবেষণায় এই চিত্র উদঘাটন করেছে। ‘ইকনোমিক ডায়নামিকস এ্যান্ড মুড অ্যাট হাউজহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এই গবেষণা ফলাফল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি মিলনায়তনে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিলুর রহমান গবেষণা রিপোর্টের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, অতি দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, আর ২০২৫ সালে এসে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, গত তিন বছরে দেশের দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এখন প্রায় ১৮ শতাংশ পরিবার যে কোনো সময় গরিব হয়ে পড়তে পারে। এই গবেষণা মে মাসে দেশের ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জনের মতামতের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে।
গবেষণা বলছে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তিনটি প্রধান সংকট রয়েছে, যেগুলোর প্রভাব পড়ছে সমাজে। এগুলো হলো: কোভিড মহামারীর प्रभाव (২০২০-২০২২), মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। পিপিআরসির আরও তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগস্টের আগে মানুষের মধ্যে ঘুষের প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। ওই সময়ের কাছাকাছি সময়ে দাঁড়িয়ে, এখনো অনেক সেবা পূর্বের তুলনায় দুর্বল হলেও কিছুটা কমে এসেছে। বিশেষ করে সরকারি অফিসে, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার হার কমেছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখা যায়, শহরের পরিবারগুলোর আয় কমছে, কিন্তু খরচ বেড়েছে। শহরের এক পরিবারের গড় মাসিক আয় এখন ৪০,৫৭৮ টাকা, যেখানে খরচ হয় ৪৪,৯৬১ টাকা। ২০২২ সালে শহরের পরিবারের গড় আয় ছিল ৪৫,৫৭৮ টাকা। অন্যদিকে, গ্রামের পরিবারগুলোর আয় কিছুটা বেড়েছে, এখন গড় আয় ২৯,০২০৫ টাকা, তবে খরচ ২৭,১৬২ টাকা। ২০২২ সালেও গ্রামের পরিবারের গড় আয় ছিল ২৬,১৬৩ টাকা। সার্বিকভাবে জাতীয়ভাবে দেখা যায়, একটি পরিবারের গড় মাসিক আয় ৩২,৬৮৫ টাকা, খরচ ৩২,৬১৫ টাকা, সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই।
খাবার খরচের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারের মোট মাসিক খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ খরচ হয় খাবার খাতে। একজন পরিবার মাসে গড়ে ১০,৬১৪ টাকা খাবার কেনায় ব্যবহার করে। এছাড়া, প্রতি মাসে শিক্ষা খাতে ১,৮২২ টাকা, চিকিৎসায় ১,৫৫৬ টাকা, যাতায়াতে ১,৪৭৮ টাকা এবং আবাসন খাতে ১,৮২৩ টাকা করে খরচ হয়।
হোসেন জিলুর রহমান বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে সরকার ক্ষুদ্র অর্থনীতির তুলনায় বৃহৎ অর্থনীতির দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। অর্থনীতির পরিকল্পনায় জনমুখী ও সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, সমতা, ন্যায়বিচার, বৈষম্য কমানো এবং নাগরিক কল্যাণও অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এছাড়া, তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে, যেমন দীর্ঘস্থায়ী রোগের বোঝা, নারীবান্ধব পরিবারগুলোর অবস্থা, ঋণের চাপ, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও স্যানিটেশন সমস্যাসমূহ। বিশেষ করে, স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে এখনও প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ ন non-স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করছে, যা জাতিসংঘের নির্ধারিত এসডিজি অর্জনকে বাধা দিচ্ছে।
কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করে হোসেন জিলুর রহমান বলেন, বর্তমানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক প্রয়োজন। বেকারত্বের হার বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফলপ্রসূ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। এই বিষয়গুলো আমাদের জরুরি প্রস্তুতির জন্য নির্দেশ করে দেয়, যে দিয়ে আমরা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে পারবো।